খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি ভ্রমণ —সাজেকের মন কাড়া প্রকৃতি আর রোমাঞ্চকর রাস্তা কে বিদায় দিয়ে আমরা চাঁদের গাড়িতে করে আবার যাত্রা শুরু করলাম খাগড়াছড়ির দিকে। গাড়ি ছাড়ার আগে প্লান হলো দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া হবে রাস্তার মধ্যেই কোন এক ভালো হোটেল দেখে। যাত্রাপথেই দেখে নেওয়া হবে ‘হাজাছড়া ঝর্ণা’ । তারপর দুপুরের পরে খাগড়াছড়ি পৌছে, যাওয়া হবে ‘আলুটিলা গুহা’ জয় করতে।
সব ঠিকঠাক মতো শুরু হলো। সকাল দশটাই রওনা দিয়ে আমরা যখন হাজাছড়া ঝর্ণার কাছাকাছি পৌছালাম তখন ঘড়িতে বাজে ১২ টা ২৫ মিনিট। মূল রাস্তা থেকে ১৫ মিনিটের পথ হাজাছড়া ঝর্ণা। হাজাছড়া ঝর্ণা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট এলাকায় অবস্থিত। ঝর্ণার হিমশীতল পানি আর সবুজে ঘেরা গিরিপথ পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। শীতকালে এর পানির প্রবাহ কমে যায়। হাজাছড়া নামক এলাকা হতে ঝর্ণার উৎপত্তি বিধায় এর নাম হাজাছড়া ঝর্ণা । এটি শুকনাছড়া ঝর্ণা বা দশ নাম্বার ঝর্ণা নামেও পরিচিত। ঝর্ণাটির স্থানীয় পাহাড়িদের দেয়া নাম হল ‘চিত জুরানি থাংঝাং ঝর্ণা’ ~ যার অর্থ ‘মন প্রশান্তির ঝর্ণা’ । বর্ষার সময় ঝর্ণার গিরিপথে পানি তুলনামূলক বেড়ে যায় এবং পথটি কর্দমাক্ত থাকে। তাই পর্যটকদের ভালো মানের গ্রিপযুক্ত ট্র্যাকিং জুতা ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয় এবং যথেষ্ঠ সর্তকতা অবলম্বন করতে বলা হয়। আমদের সময়টা বর্শাকাল ছিলোনা, তাই রাস্তা শুকনো ছিলো। স্যারেরা আমাদের ঝর্ণা ঘুরে আসার জন্য ২৫ মিনিট সময় বেধে দিলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে হাটা শুরু করলাম।
উচু নিচু রাস্তা পেরিয়ে মিনিট ১৫ পরেই ঝর্ণার পানির শব্দ শুনতে পেলাম। ঝর্ণায় মোটামোটি ভালোই পানির প্রবাহ ছিলো। ঝর্ণাই পৌছাতে না পৌছাতেই, আমাদের দুই বন্ধু বয়ে আসা পানির উৎস খুঁজতে দুর্গম এক রাস্তা ধরে উঠা শুরু করলো উপরের দিকে। বিষয়টা আমার অনুভূতিতে বেশ ট্রিগার দিচ্ছিলো। আমি অপেক্ষায় থাকলাম তারা কি তথ্য নিয়ে আসে। এর ফাকে ঝর্ণার নিচে ছবি তোলার কাজটা সেরে নিলাম। সময় কম থাকায় তাদেরকে দ্রুত ব্যাক করতে হলো। এসে জানালো তেমন কিছুই তারা দেখতে পারেনাই। তবে মনে করা হচ্ছিলো মেঘেরা এসে ঝর্নার মাথায় মিলিয়ে যাই, ফলাফল হিসাবে পানির এতো প্রবাহ আমরা দেখতে পাই। রহস্যময় ঝর্ণা নিয়ে কিছুটা জানা গেলেও কিছু বিষয় রয়ে গেলো মহান আল্লাহ তায়ালার একান্ত নিজের কাছে। যাইহোক, হাঝাছড়াই ত্রিশ মিনিটের মতো সময় কাটিয়ে আবার আমরা গাড়িতে ব্যাক করলাম। গাড়িতে উঠার আগে এক স্থানিয় দোকান থেকে ডাব কিনে ডাবের পানি খাইতে খাইতে চলতে শুরু করলাম খাগড়াছড়ি শহরের দিকে।
খাগড়াছড়ি পৌছানোর আগেই আমাদের চাঁদের গাড়ীটা এক রেস্টুরেন্ট এর পাশে থামানো হলো, উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার টা সেরে নেওয়া। রেস্টুরেন্ট টা ছিলো চাকমা এক মহিলার। গাড়ি থেকে নেমে আমরা যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার টা সেরে নিলাম। খাবার টা খুব টেস্টি না হলেও ফ্রেশ ছিলো, যা আমাদের ভ্রমণের জন্য খুব সহায়ক ছিলো। কারন আপনি ভ্রমণের সময় যত পারেন কম এবং ফ্রেশ খাবার খাবেন ততো ভালো থাকবেন। খাবারের পর ৫-১০ মিনিট রেস্ট নিলাম, তারপর আবার চাঁদের গাড়িতে উঠে বসলাম।খাগড়াছড়ি শহরে এসে যখন আমরা পৌছালাম, তখন আনুমানিক দুপুর ২ টা বাজে। পৌছানার পরপরই তাড়াতাড়ি করে চাঁদের গাড়ি থেকে নেমে, লাগেজগুলো উঠিয়ে নিলাম আমাদের মেইন বাসে। নাহিদ ভাই~ আমাদের মেনটর বললো ২০-২৫ মিনিট লাগবে এখান থেকে আলুটিলা গুহা পৌছাতে।
রোমাঞ্চকর আলুটিলা জয় —আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমরা আলুটিলা পৌছাইলাম। আলুটিলা জয় করার আগে আলুটিলা নিয়ে কিছু তথ্য দিয়ে দিয় আপনাদের। আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলারমাটিরাঙ্গা উপজেলায় মূল শহর হতে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল হতে ৩০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আলুটিলা বা আরবারী পাহাড়ে আলুটিলা গুহা অবস্থিত। স্থানীয়রা একে বলে ‘মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা’ । এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। কোন প্রকার সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বলে মশাল নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। আগেই বলে রাখি, আপনাকে গেটে টিকিট কেটে নিতে হবে। আর গুহা টা অন্ধকার হওয়াই মশাল কিনে নিতে হবে। তবে ভালো টর্চ বা মোবাইলের লাইট দিয়েও আপনি গুহা জয় করতে পারবেন। আমরা মোবাইলের টর্চ দিয়েই গুহা পার হয়েছিলাম।মেইন গুহাই প্রবেশের পূর্বে ২৬৬ টি সিড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে হয়। আমরা সবাই নামতে শুরু করলাম সিড়ির দিকে। সিড়ি পৌছানোর পূর্বেই কিছুটা পাকা করা রাস্তা নামতে হয়, এটা খুবই ঢালু। হাঁটার চেয়ে দৌড়ায়ে নামলেই শক্তি কম ব্যয় হয়, কারণ টা আমরা সবাই জানি। আমরা বেশ কয়েকজন দৌড়ায়ে নামলাম। সিড়ি দিয়ে মেইন পথে যাওয়ার পূর্বে, হাতের ডানদিকে একটা সুদর্শন যায়গা পাওয়া যায়। এইখান থেকে পুরো মাটিরাঙ্গা উপজেলা টা দেখা যায়।
এই যায়গাটাই চটপট আমি কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। সিড়ি বেয়ে নামতেছি তো নামতেছি। মাঝে মাঝে কয়েকটা সিড়ি এক লাফে নেমে যাচ্ছি। উত্তেজনা ভর করেছে আমার মনে ততক্ষনে, কখন দেখবো কাঙ্খিতো সেই গুহাটা। আনুমানিক ৪ থেকে ৫ মিনিট পর গুহার দর্শন অবশেষ পাওয়া গেলো।আমরা দ্রুত হাতের টর্চ টা জ়ালিয়ে নিয়ে গুহার ভিতরে ঢুকা শুরু করলাম। খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে , গুহার তলদেশ টা পিচ্ছিল এবং পাথুরে ও এর তলদেশে একটি মৃদু ঝর্ণা প্রবাহমান । গুহাটি দেখতে অনেকটা ভূ-গর্ভস্থ টানেলের মত, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট । আমাদের অনেকেই ভয় পাচ্ছিলো অন্ধকারে। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে দারুন রোমাঞ্চকর ছিলো। নিচু হয়ে আমরা পা টিপে টিপে হাঠছিলাম। অনেক্ষন হবে, আনুমানিক ১০ থেকে ১২ মিনিট লাগলো পুরো গুহাটা পার হতে। অনেক্ষন অন্ধকারে থাকার পরে আলোর মুখ দেখতে পেয়ে আমার আদিম মানুষদের কথা মনে পরলো। তারা কিভাবে বছরের পর বছর গুহার অন্ধকারে জীবন কাটাতো!
আলুটিলা জয় করার অনুভূতিটা দারুন ছিলো। তাই বের হয়ে আমরা দিনের আলোয় ছবি তুলতেছিলাম। শরীর ইতমধ্যে ঘেমে গেছে আমার।যাইহোক, ফটোশুট শেষ করে এবার আমরা উপোরের দিকে ফিরতে লাগলাম। ফিরার পথ টা কষ্টকর ছিলো। কারণ পুরোটায় অভিকর্ষ বলের বিপরীতে হাটতে হচ্ছিলো আমাদের। সবাই হাটতেছিলো ধীর গতিতে, আমি আর জাহাঙ্গীর কিছুক্ষন হাটার পর ঠিক করলাম, দ্রুত দৌড়ে উপরে উঠে মেইন রাস্তার ডান দিকে কি আছে তা দেখে আসবো। ১৫ মিনিট অভিকর্ষ বলের বিপরীতে দৌড়িয়ে আমরা পাশের রাস্তাটার শেষ মাথায় কি আছে তা দেখতে আসলাম। এসে তেমন কিছু দেখলামনা, কয়েকটা দোলনা ছিলো, যেখনে দোল খেতে খেতে পাহাড়ের নিচের দৃশ্য গুলো উপভোগ করা যায়। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় কিছুক্ষনের মধ্যে আমদেরকে আবার মেইন গেটের কাছে পৌছাতে হলো। গেটের কাছে পৌছানোর পর, তৃষ্ণার্ত আমি ২০ টাকার পানির বোতল ৩০ টাকাই কিনে খাইতে শুরু করলাম চোখ বন্ধ করে। আমি যখন পানি খাচ্ছিলাম তখন দেখলাম জুয়েল সহ আরো আমার কয়েকজন বন্ধু শাহাদাত স্যারকে ধরে উপরের দিকে নিয়ে আসতেছে। পরে জানা গেলো স্যারকে ‘হাইট সিকনেস ‘ এ আট্যাক করেছিলো। উপোরে পৌছানোর পর আমরা সবাই মিনিট পাঁচেক রেস্ট নিয়ে আবার বাসের দিকে হাটা শুরু করলাম। আমাদের নেস্কট গন্তব্য হবে রাঙ্গামাটি জেলা।
খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি —আলুটিলা জয় করে যখন বাসে এসে বসলাম তখন ঘড়িতে বাজে আনুমানিক ৩ টা ১৫ মিনিট। শরীরটা ক্লান্ত আর চোখে ঘুম ঘুম ভাব। আলুটিলাকে পেছনে ফেলে পাহাড়ের রোমাঞ্চকর রাস্তা বেয়ে যখন বাস চলা শুরু করলো, তখন জানালা দিয়ে আসা বাতাস শান্তির ঘুমকে ডেকে নিয়ে আসলো আমার চোখে। ঘন্টা দেড়্রেক পার হয়ে গেল এভাবেই। ঘড়িতে বিকেল ৫ টা ১২ ! আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাস দাড়িয়ে আছে এক পাহাড়ের পাশে। কয়েকজন বাস থেকে নেমেছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। আমিও ঘুম থেকে উঠে নিচে নামলাম পরিবেশটা একবার দেখার জন্য। সময় পেয়ে হাতের বোতলের পানি দিয়ে অযূ করে নিলাম। তারপর বাসে উঠে মাগরিব আর আসরের নামাজ আদাই করে নিলাম একসাথে। বাস চলতেছে রাঙ্গামাটি শহরের দিকে। বাসের ভিতোর আবার জমে উঠলো আড্ডা, গান আর ফেলে আসা আলুটিলাকে নিয়ে মজার মজার স্মৃতি চারণ।
এভাবেই আড্ডা, গান আর আবছা ঘুম চোখে আমরা পৌছে গেলাম রাঙ্গামাটিতে। যখন আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম, তখন ঘড়িতে রাত ৮ টা বাজে।আমরা যে যার মতো দ্রূত গোশল সেরে নিলাম। তারপর ১৫ মিনিটের জন্য বেডে শরীর টা রাখলাম। হঠাৎ ডাক পড়লো ! আদেশ হচ্ছে, ৯ টার দিকে ডিনার হবে। হোটেলের নিচে নামতে হবে ৮ টা ৫০ এর মধ্যে। কিছুক্ষন পরে নামতে হলো। আমরা রাতের ডিনার করে হাল্কা কেনা কাটা করলাম। সব শেষ করে যখন রুমে ফেরলাম তখন রাত বাজে ১১ টা ২০। রুমে ফিরে ব্যাগ গুলো রেখেই দৌড় দিলাম ফয়সাল স্যার এর রুমের দিকে। কার্ড খেলার টুর্ণামেন্ট শুরু হয়ে যাবে ১২ টার মধ্যেই। কার্ড বোর্ডে হাসাহাসি আর সারাদিনের গল্প শেষ করে ঘুমোতে এলাম রাত আড়াইটার দিকে। সকালে উঠে রাঙ্গামাটি ঘুরে দেখার পালা। আহ!! জীবন সুন্দর!
রাঙ্গামাটির সকাল — ‘বনভান্তের বৌদ্ধ মন্দির’ —সকালে উঠে খুব দ্রূত রেডি হতে হলো। আমাদের জন্য নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, রাঙ্গামাটির সকালে প্রথম দর্শন করা হবে বনভান্তের বৌদ্ধ মন্দিরটা। আমার মন্দির এর প্রতি কোন আকর্ষণ কখনই কাজ় করেনা, এবারো করতেছিলোনা। তারপরেও যাইতে হলো সবার সাথে। ১৫ মিনিটের নৌকা যাত্রার পর আমরা পৌছালাম মন্দিরে। মন্দিরটা একদম সাদামাটা ছিলো, ব্যতিক্রম ছিলো একটা দুর্গের মতো। তবে মন্দিরটার পার্শে কিছু বানরের দেখা মিল্লো আমাদের সাথে। তারা যাত্রা পথে আমাদের সাথে মজা করতেছিলো। আমারাও সুযোগ বুঝে বানরদের সাথে ভালোই মজা করলাম। তারপর আবার ফিরতি পথে নৌকাই এসে বসলাম মন মুগ্ধকর কাপ্তাই লেক কে দেখার জন্য।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি ভ্রমণ—কাপ্তাই লেকঃ FINEST BOAT TRIP EVER —নৌকা ভ্রমণ আসলে কতটা মজার হতে পারে তা কাপ্তাই লেক না গেলে কখনো বোঝা যেতনা হয়তো। দুপাশে পাহাড় আর উপুরে নীল আকাশ, এর মাঝে পানির বুক চিরে চলা নৌকার ফাল। লোক বেশি থাকায়, আমাদের নৌকাটা বেশ বড়ো আকৃতির ছিলো। নৌকার ছাদে বসেও প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা ছিলো। প্রথম দিকে আমরা নৌকার মেইন রুমেই বসে ছিলাম। কিছুক্ষন নিচে বসে থাকার পর যখন ম্যাশিনের শব্দে মাথা টা ঝিম ঝিম করতেছিলো, তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নৌকার ছাদে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।নৌকার ছাদে উঠার পর দেখতে পেলাম আসল প্রকৃতি। দুপাশে বিশাল বড় বড় পাথরের পাহাড়, আর বৃস্তিতো কাপ্তাই এর পানির লিলাখেলা। আমাদের নৌকাকে পিছোনে ফেলে অনেক সময় ই স্পিড বোট গুলো চলে যাচ্ছিলো। কয়েকজন ভ্রমণপিয়াশু হলে স্পিড বোট বেটার। তবে আমার মতে , স্পিড বোট এর চেয়ে বড়ো নৌকাতে চড়ে কাপ্তাই লেক দেখার মজ়া বেশি, কারণ বড় নৌকাতে সময় বেশি পাওয়া যায় এবং দৃশ্য গুলো মন ভরে দেখা যাই।
আমরা দৃশ্য গুলো দেখতেছিলাম আর স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি করতেছিলাম। আমার মিরাজ বন্ধু তার ‘Youtube’ চ্যানেল এর জন্য যথারিতী ভিডিও করে যাচ্ছিলো। এদিকে নৌকার উপরে চলতেছিলো মজার মজার গান আর পানির বোতল দিয়ে ঢোলের মতো শব্দ করার চেষ্টা। গানে যথারিতী নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলো ‘ আশরাফুল’, ‘লিটন’ আর বন্ধু ‘নাহিদ’ । আমরা গানের সাথে সুর মিলাচ্ছিলাম আর চোখ জোড়ানো প্রকৃতি গুলো দেখতেছিলাম। ২ ঘন্টার স্মরণীয় নৌকা ভ্রমণ এভাবেই দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো। এখন আমাদের নৌকাটা ভেড়ানো হচ্ছে এক ঘাটে। নাহিদ ভাই বললো আমরা পৌছে গেছি শুভ্লং পাহাড়ের কাছাকাছ।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি ভ্রমণ—‘শুভলং পাহাড়’ জয়ঃ Breathtaking Hiking Experience —মনমুগ্ধকর কাপ্তাই ভ্রমণ শেষ করে আমরা যখন নৌকা থেকে নামলাম তখন ঘড়িতে বাজে বেলা ১১ টা ৪০ মিনিট। আমরা যে যায়গাটাতে নেমেছি এটার নাম হচ্ছে শুভলং। এই যায়গাটা দুটি কারণে বিখ্যাত, এক, শুভলং ঝরণা এবং দুই , শুভলং পাহাড় । শুভলং পাহাড়টা ৩০০ ফুট উচু এবং বেশ খাড়া। আমদের ট্যুর গাইডার নাহিদ ভাই বল্লো এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠা নাকি অনেক কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। অনেকেই উঠার এটেম্পট নেয়, তবে খুব কম সংখ্যক পর্যটক ই শেষ পর্যন্ত চূড়াই উঠতে পারে। এই শুনে আমাদের ফয়সাল স্যার আমাদের হাতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বল্লো, ‘যারা যারা চুড়ায় উঠতে পারবে তাদের জন্য বিশেষ পুরষ্কারের ব্যবস্থা আছে’। এই কথা শুনে আমরা সবাই বড় একটা দম নিয়ে উঠতে শুরু করলাম।
প্রথম দিকে হাল্কা সিড়ির মতো থাকলেও কিছুদূর যাওয়ার পরে আর তেমন কোন সিড়ির দেখা মিললোনা। ৫ থেকে ৭ মিনিট পার হয়ে গেছে, আমরা সহ আরো অনেক পর্যটক শুভলং কে জয় করার উদ্দেশ্যে উপরের দিকে উঠতেছি। যতই সময় যাচ্ছে পাহাড় এর আঙ্গেল ততোই ৯০ ডিগ্রীর দিকে ধাবিত হচ্ছে । কিছু কিছু যায়গা একেবারে খাড়া উঠতে হচ্ছিলো। মিনিট পনেরো ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে, নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার অনেক বন্ধুরা নিচের দিকে ফিরে যাওয়া শুরু করেছে। তারা আর উঠতে পারতেছিলোনা তাই নিচে নামা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা ১৭-১৮ জন হাল ছাড়লামনা!মাঝে মাঝে রেস্ট নিই আবার উঠি, রেস্ট নিই আবার উঠি। এভাবে উঠতে উঠতে একটা পর্যায়ে নাহিদ ভায়ের কথা মনে পড়লো, কেনো তিনি বলেছিলেন যে এই পাহাড়ে উঠা অনেক কষ্টের ব্যাপার হবে! তারমধ্যে আমাদের একটা ভুল হয়েছিলো, আমরা কেওই হাতে পানির বোতল নিয়ে উঠিনাই। তৃষ্ণায় জীবন দুরহ হয়ে উঠতে লাগলো। তাই আপনাদের উদ্দ্যেশ্য করে বলে রাখতেছি যারা শুভলং জয় করতে যাবেন তারা অবশ্যই সাথে বড় পানির বোতল রাখবেন।
যাইহোক আমরা নাছড় বান্দা, হাল ছাড়লামনা। বয়স তো মাত্র বাইশ, এখন যদি না পারি তাইলে আর কখন! !২৭ থেকে ২৮ মিনিট লাগলো আমাদের শুভলং এর চুড়াই উঠতে। আমরা মোট ৩৭ জনের মধ্যে মাত্র ১৩-১৪ জ়ন উঠতে পেরেছিলাম শেষ পর্যন্ত। মাথাই উঠে আমি হন্ন হয়ে একটা জিনিস ই খুজতেছিলাম সেটা হচ্ছে পানি। শেষ পর্যন্ত পেলাম তাকে। ১৫ টাকার পানির বোতল ৫০ টাকাই কিনে ঢকঢক করে খাইতে লাগলাম। ইতোমধ্যে আমার টি শার্ট সহ সারা শরীর পুরোটা ঘামে ভিজে গেছে। শুভলং এর চূড়ায় বিজয়িরা কিছুক্ষন ফটশুট করে শান্ত হয়ে নিচের দিকটা দেখতে লাগলাম। আর ভাবলাম আহ! কি হাইকিং ছিলো এটা,মনের মধ্যে অসাধারণ ফিল হচ্ছিলো এ কারণে যে, Finally We Won it.পাহাড়ের চূড়ায় মিনিট দশেক কাটিয়ে আবার নামা শুরু করলাম। নামাটা সহজ হলেও সাবধাণতা ছিলো অনেক, কেননা একবার পা পিছলালেই জীবন শেষ। ১০-১৫ মিনিট ধরে পা টিপে টিপে আর লাঠির সহোযগিতাই আমারা নিচে নেমে এলাম। নিচে এসে দেখি বিশাল বড় বড় ডাব বিক্রি করতেছে। ৫০ টাকার একটা বিশাল সাইজ়ের ডাব কিনে খাইতে খাইতে আমি আমাদের নৌকায় আবার চড়ে বসলাম।নৌকা ছেড়ে দিলো শুভলং কে বিদায় দিয়ে। শুভলং পাহড় থেকে ফেরার পথে শুভলং ঝর্ণার কাছে একবার নৌকা নিয়ে গিয়েছিলো। দুঃখের বিষয় ঝর্ণাই কোন পানির দেখা মিললোনা। হতাশ আমরা ফিরলাম শুভলং কে বিদাই দিয়ে। মিশ্র এক আনুভূতি নিয়ে আবার আমরা রাঙ্গামাটি শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
হঠাৎ শুনতে পাওয়া গেলো, আমাদের দুপুরের খাবার হবে ‘ বাম্বো চিকেন’ দিয়ে, তাও আবার কোন এক নির্জন আইসোলেটেড দ্বীপে। বিষয়টা বেশ ফান্টাসি জাগালো মনে, কেননা এ রেসিপির নাম শুনেছিলাম আমি। বাট ফাইনালি আমরা খেতে যাচ্ছি ভেবে ভিষণ ভালো লাগতেছিলো। নৌকা চলতেছে আমরা সবাই কিছুক্ষনের জন্য শান্ত হয়ে প্রকৃতি দেখতেছি। শুভলং পাহাড় অনেক এনার্জ়ি লস করিয়েছে আমাদের। এবার বাম্বো চিকেন খেয়ে তা শোধ করার পালা।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি ভ্রমণ—অচিন দ্বীপে ~ Lunch with ‘Bamboo Chicken’ — শুভলং কে বিদায় দেওয়ার ত্রিশ মিনিট বাদে আমাদের নৌকাটা থামানো হলো এক দ্বীপের কাছে। টা দ্বীপ টা অনেক ছোট ছিলো, কিন্তু চারপাশের আবোহাওয়া টা ছিলো দারূন । সেখানে একটা বাশ দিয়ে বানানো চাতায় ছিলো, ছিলো কিছু ছোট ছোট দোকান, আরাম করার জন্য দোলানা আর ছিলো কাঙ্খিতো সেই হোটেল। যেখানে আমরা বাম্বো চিকেন রেসিপিটা খাবো। আমারা নৌকা থেকে নামার পরপরই খাবার এর অর্ডার টা দিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলাম। ত্রিশ মিনিট পর খবর আসলো, রান্না শেষ হয়ে গেছে, আমাদেরকে টেবিলে বসতে বলা হলো। আমরা বসে পড়লাম টেবিলে খাইতে। বাম্বো চিকেন রেসিপিটা হচ্ছে আসলে বাশের মধ্যে চিকেন কে রান্না করা হয়, আর সাথে থাকে কাঁচা বাশের রান্না করা তরকারি । খেতে বেশ ডেলিশিওয়াস ছিলো রান্নাটা। আমরা বাম্বো চিকেন দিয়ে উদর পূর্তি করে দোলানাই হালকা বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম। এর মধ্যে শুনা গেলো আমার বন্ধু শফি সহ কয়েকজন সিংগেল বোট নিয়ে কাপ্তায়ের মধ্যে চলে গেসে নৌকা বাইচ করতে। আমারো ইচ্ছে হচ্ছিলো কিন্ত কোন ফ্রি বোট না পাওয়াই তা আর মেটানো হলোনা।এদিকে আমরা ছবি তুলতেছিলাম রিতিমতো। কিছুক্ষন পর শফিরা ফিরে আসলো, কিন্তু গোশল হয়ে। জানা গেলো তারা নৌকা চালাতে গিয়ে উলটা খেয়ে পড়ে গেছিলো। বিষয়টা আমাদের জন্য মজার ছিলো, আবার তাদের জন্য ভালোই ছিলো, কেননা তাদের কাপ্তায়ে গোশল ও হয়ে গেলো।
আমরা আচিন দীপে ১ ঘন্টার মতো সময় কাটিয়ে আবার নৌকাই চড়ে বসলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ম্যাজিকাল ঝুলন্ত ব্রিজ।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি ভ্রমণ— ঝুলন্ত ব্রীজ —আচিন দীপকে পিছনে ফেলে আমরা এবার যাত্রা শুরু করলাম রাঙ্গামাটিতে আমাদের শেষ স্পট ঝুলন্ত ব্রীজ এর দিকে। আমরা নৌকা করে যখন ঝুলন্ত ব্রীজে পৌছালাম তখন ঘড়িতে বাজে বিকেল ৪ টা। ঝুলন্ত ব্রীজ মানে এটার নিচে কোন পিলার থাকার কথা না, কিন্তু আমরা গিয়ে দেখলাম আসলে বিষয়টা সঠিক না। ব্রীজের দুপাশে পিলার আছে কিন্তু লোহার দড়ি দিয়ে ব্রীজকে এমন ভাবে টানা দেওয়া আছে যে, মনে হচ্ছে ব্রীজটা ঝুলে আছে।
আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমরা দ্রুত পিকচার তুলতে থাকলাম। বলে রাখা ভালো ঝুলন্ত ব্রীজে উঠার জন্য টিকিট কাটতে হয়েছিলো আমাদের। প্রত্যেক টা টিকেটের মূল্য ছিলো ২০ টাকা, আপনারা ঐখানে ঘুরতে গেলে এ বিষয়টা মাথায় রাখবেন।আরটিফিশিয়াল জিনিশ প্রকৃতির চেয়ে অনেক কম সুন্দর হয়। তাই ঝুলন্ত ব্রীজ নিয়ে যতো কথা শুনেছিলাম ততোটা ভালো লাগ্লোনা। তারপরেও দেখা হয়ে গেলো ফেমাস ঝুলোন্ত ব্রীজ টা। ঝুলোন্ত ব্রীজ দেখা শেষ করে আবার নৌকাই চড়ে বসলাম আমরা। দ্র্রত বাসে উঠতে হবে, কারণ আমাদের নেক্সট গন্তব্য সপ্নের ‘বান্দরবন’ । আমরা ২০ মিনিট এর মধ্যে নৌকা যাত্রার শেষ করলাম। সারাদিন পর নৌকা কে বিদাই দিয়ে বাসের দিকে হাটতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম দিনটা কতো সুন্দর ছিলো!