ইন্টার্নশিপ শেষ হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক হলো। তিন মাসের এক অসাধারন রিসার্চ এক্সপেরিয়ান্স ছিলো – যেটার  গল্প লিখতেছি আরেকটি ব্লগে – হোপফুলি আসবে খুব তাড়াতাড়ি। এই ব্লগে লিখতেছি গত সপ্তাহে হয়ে যাওয়া আমাদের ল্যাব আউটিং নিয়ে। ল্যাব আউটিং এর কন্টেক্সটা ছিলো খুব স্পেশালঃ আমার প্রফেসর ১ মাস আগে ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো রিসার্চ গ্রান্ড ANR পেয়েছে (৫ মিলিয়ন ইউরোর একটা রিসার্চ গ্রান্ট)। অন্যদিকে আমাদের ল্যাব থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে ল্যাবের প্রথম পোস্টডোক Eloise। তো সবমিলিয়ে ল্যাব আউটিং করার প্লাটফর্মটা রেডি ছিলো। ল্যাবের প্রফেসর আমদের হাতে ছেড়ে দিলো কি কি করা যায় তার একটা প্লান করে ফেলার জন্য।

এই অপার স্বাধীনতা কে কাজে লাগিয়ে আমার কো-সুপারভাইজর – আমাদের ল্যাবের মাদার ফিগার এবং রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার –আইডিয়া দিলো গলফ খেলার। খেলা শেষে গলফ মাঠের পাশের কাফে তে আড্ডা দিয়ে ল্যাবের সবার রিসেন্ট সাকসেস সেলেব্রেট করা হবে এ মর্মে আমার প্রফেসরসহ অন্যান্য সব ল্যামেম্বাররা রাজি হয়ে গেলো। গলফ খেলতে রাজি হবার পিছনে সবার কারন টা ছিলো খুব স্বাধারন – আমরা কেউই কোনদিন গলফ খেলিনাই (:D)। অন্যদিকে, আমার সাইড থেকে গলফ নিয়ে জানাশুনার দৌড় একদমই নগন্য – আমি শুধু জানতাম এটি একটি “এক্সপেন্সিভ” খেলা এবং এটা বড়লোক আমেরিকান, টাইগার উড এবং আমাদের দেশের সিদ্দিকুর রহমান ছাড়া আর কেউ খেলেনা (:D)।

বুধবার বিকেলে ৫ টা থেকে ৬ টা ত্রিশ আমাদের গলফ ফিল্ড বুক করা ছিলো। প্লান ছিলো – লং এন্ড মিনি – দু ধরনের গলফ-ই আমরা ট্রাই করবো। আমরা ছিলাম ফুল টিম – আমার প্রফেসর, কোসুপারভাইজর, তিনজন পিএইচডি Student, একজন পোস্টডক, আর আমিসহ দুজন মাস্টার্স ইন্টার্ণ। সাথে ফ্রি ট্রেইনার হিসেবে ছিলো আমাদের এক পিএইচডি স্কলারের হাজবেন্ড (ইনার কারনেই এই ব্লগ টা লিখতে বসা – ব্লগ পড়া শেষ হলে সেটা টের পাবেন) ।  

গলফ ক্লাবটা আমাদের ল্যাব থেকে হাটার দুরত্বে – ১০ মিনিট এর মতো হবে। আমরা সবাই একসাথে ল্যাব থেকে বের হয়ে হেটে গলফ ক্লাবে গেলাম, এবং আগেই সিডিউল বুক করা থাকার কারনে আমরা ক্লাবে যাওয়া মাত্রই আমাদের কে গলফ কোর্টের স্পেসিফিক যায়গা দিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু বড় স্টিক, মিনি গলফ খেলার জন্য স্পেশাল স্টিক এবং গলফ বল ভাড়া করতে হলো আলাদা করে। মজার বেপার বামহাতি এবং ডানহাতির জন্য যে গলফ স্টিকের ধরন আলাদা হয় এটা আগে আমাদের কারো জানা ছিলোনা। এখানে বলে রাখি, একেকটা গলফ স্টিক এর দাম প্রায় ৫০০-১০০০ ইউরো (৫০,০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা), সাথে বল ভাড়া করা এবং আরো অনেক জিনিস-পাতি তো আছেই। তাহলে একবার ভেবে দেখেন কেনো মানুষ এই খেলাটাকে খুব ‘এক্সপেন্সিভ’ বা ‘বড়লোকের খেলা’ বলবেনা। যাইহোক, বলসহ স্টিকগুলো ভাড়া করার দরূন আমরা কম দামেই সব পেলাম (সব মিলিয়া ১৫০ ইউরোর মতো লেগেছিল – পরে যা শুনলাম)। আমাদের সবার জন্য গলফ স্টিক এবং বাস্কেট ভর্তি বল ভাড়া করা শেষ, এবার খেলা শুরু করার পালা!

প্রথমে আমরা নিজেদের মধ্যে দুটো টিমে ভাগ হয়ে গেলাম – একদল গেলো মিনি গলফ খেলতে; অন্যদিকে আমি, আমার প্রফেসর, আঞ্চি (যার হাজবেন্ড Toni আমাদের ট্রেইনার), ম্যাক্সিম (আমার সবচেয়ে কাছের পিএইচডি Student), আর আমার কো-সুপারভাইজর থেকে গেলাম লং শট শেখা এবং খেলার জন্য।

লং শটের প্রথমদিকে খুব নারভাস লাগতেছিলো আদৌ কি বল স্টিকে লাগাইতে পারবো কি না এই নিয়ে। যাইহোক, Toni আমাদের প্রত্যেককে গলফের ব্যাসিক বিষয়গুলো নিয়ে ১০ মিনিট ধরে গ্রুমিং করালো এবং হিট করার আগে সবার গ্রিপ, হিপ, এন্ড ফুট পজিশন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। তারপর আমরা সবাই প্রাকটিস শুরু করলাম। আমি প্রথম যে সুইং টা নিলাম সেটা বলকে টাচ না করেই পার হয়ে গেলো – সত্যি বলতে নিজে্র কাছে নিজেকে খুব ইম্বারেসড লাগতেছিলো তখন। যাইহোক, Toni আমাকে বললো হেড পজিশন এবং বলের উপর মনযোগ থাকাটা কতটা গুরুত্বপূর্ন। তো আমি তার কথাকে ফলো করে বলের উপর যতটা মনযোগ রাখা যায় সেটা রেখে, আমার নি দুটোকে একটু বেন্ড করে একটা হিট নিলাম – গেজ হোয়াট? আমার গলফ স্টিকের বলের সাথে কানেকশন হলো এবং বল উড়ে প্রায় ৬০ মিটার দূরে গিয়ে পড়লো। Toni আমাকে কংগ্রাটস দিয়ে বললো, “Great Men! You are connecting the ball now!!”

প্রথম হিটটা কানেক্ট করার পর আমার মধ্যেও একটা কনফিডেন্ট এসে গেলো এবং আমার মনে হতে লাগলো এটাতে আমার জীবনের ফেভারিট গেম ক্রিকেট এর ব্যাট সুইং এর মতোই। বরং, ক্রিকেট এর চাইতে অনেকাংশে সহজ কারন এখানে বল স্থির – ক্রিকেটে তো বল গতিশীল এবং মাঝে মাঝে ঘুর্ণয়মান থাকে। এই সাধারন ফিজিক্স টা মাথার মধ্যে ঢুকার পর থেকে প্রত্যেকটা হিট কানেক্ট হওয়া শুরু হলো এবং একেকটা হিট ১০০ মিটার এর বার ক্রস করে পরতে শুরু করলো। টনির খুশি দেখে কে!! সে বলতে লাগলো, “Men how do you connect that ball so well in your first day in golf court? Did you have previous experience??” উত্তরে আমি বললাম, “Not in Golf, but in Cricket, Yes!! In fact, from school to university, I represent my class or section or department in competitive cricket tournament as an opening batsman.’’ সে আমার কথার সাথে এগ্রি করলো, “I was thinking the same Men! Otherwise it’s not possible in one day.’’

যাইহোক পরের ১০-১৫ মিনিটে আমি একাই দুই বাস্কেট বল হিট করলাম, একেক্টা ১০০-১৫০ মিটার দূরে গিয়ে পড়তে লাগলো। তার উপর যখন কয়েকটা হিট ১৬০ মিটার ক্রস করে ডিজাইরড hotspot (গ্রিন টাফে) পড়তে লাগলো, তখন আমার প্রফেসর সহ সবাই তাদের খেলা বন্ধ করে আমার গলফ হিট দেখা শুরু করলো। সবাই প্রবাবলি ভাবতেছিল এই ছেলেটা করতেছে কি গলফ বলটারে? 😀 একটা পর্যায়ে আমার প্রত্যেকটা লং হিটের পর সবাই তালি এবং হুইসেল দিচ্ছিলো – আমি যাতে আমার আরো ভালো শট-টা নিতে পারি।

Overall, it was such an amazing session that after a long time, I felt like I am experiencing my old cricket-heating nerves. 

 

সফল লং গলফ সেশন শেষ করে আমাদের টিম গেলাম মিনি গলফ কোর্টে আর আমাদের সেকেণ্ড টিম আসলো লং গলফ কোর্টে। মিনি গলফটা লং গলফ থেকে সম্পূর্ন আলাদা। লং গলফে দরকার পাওয়ার, পজিশন এন্ড মনযোগ ধরে রেখে যাস্ট হিট করার স্কিল, কিন্তু মিনি গলফ তার পুরোটাই উলটো। মিনি গলফে দরকার ডেলিকেট টাচ, কারভ শর্ট খেলার স্কিল, এবং যে অবস্টাকল গুলো কোর্টে দেওয়া থাকে (পন্ড, ব্রিজ, হিল, মাউন্টেন) সেগুলোকে ডিঙ্গিয়ে টার্গেট গর্তে কত কম বার হিট করে বল ফেলা যায় সেটার প্রতিযোগিতা।

সত্য বলতে সবাই আমরা মিনি গলফে স্ট্রাগল করতেছিলাম – যদিও মজা পেয়েছি অনেক! – এবং নিজেদের খেলা নিয়ে নিজেরেই হাঁসাহাঁসি করছিলাম। অনেক বার এমন হয়েছে, একটু জোরে হিট করার দরূন বল কোর্ট পার হয়ে বাইরে চলে গেছে; অথবা নির্দিষ্ট গর্তে ফেলতে ৭-৮ বার হিট করা লাগছে। বলে রাখা ভালো, মিনি গলফ কোর্টে ১০ ধরনের চালেঞ্জ ছিলো – একেক্টার চ্যালেঞ্জ একেকধরনের – এবং ১-১০ নাম্বার কোর্টের ডিফিকাল্টি আসেণ্ডিং ওয়েতে বাড়তেছিলো। তাছাড়া, ১০ নাম্বার কোর্টে আমরা সবাই ২/৩ বার করে চেস্টা করেও বল গর্তের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারিনাই। যাইহোক, মিনি গলফ শেষ করতে না করতেই আমাদের ১ ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের বুক করা সিডিউল শেষ হয়ে এলো। বেলা তখন ৬ টা বেজে ত্রিশ, প্যারিসের দিন গুলো এখন অনেক বড় হওয়াই, তখনো সূর্যের আলো ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিলো। আমরা আমাদের জীবনের প্রথম গলফ সেশন শেষ করে, ভাড়া করা স্টিক গুলো ফেরেত দিয়ে, ক্যাফের দিকে সবাই আগাতে লাগলাম। 

ক্যাফে তে এসে সবাই সবার মতো ড্রিঙ্কস নিলাম, সাথে নিলাম বিভিন্ন ধরনের চিপ্স। আমার ল্যাবের সবাই এতদিনে জেনে গেছে আমি কি খাই! 😀 তাই, আমার প্রফেসর আমাকে কোক অথবা অরেঞ্জ জ্যুস অফার করলো। আমি ধন্যবাদ দিয়ে কোক নিতে রাজি হলাম। তারপর বাইরে এসে দুটো টেবিল কে এক করে চারিদিকে চেয়ার সাজিয়ে সবাই বসে পড়লাম গল্প করতে।

গল্পের টেবিলে আমার ডান পাশে ছিলো টনি – আঞ্চির হাজবেন্ড – আর আঞ্চি। আঞ্চি ব্রাউন থেকে আপ্লাইড ম্যাথেমেটিক্স এ ব্যাচেলর আর বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স করে আমাদের ল্যাব আর পাস্তুর ইন্সটিটিউট এর কলাবরেশনে এসেছে পিএইচডি করতে। আমদের ল্যাবের অনেকগুলো স্মার্ট পিপল এর মধ্যে আঞ্চিকে সহজেই আলাদা করা যায়। তার কাজ হলো ম্যাশিন লার্নিং এন্ড কম্পিউটিশনাল মডেলিং এর সাথে নিউরোবায়োলজি কে এক করে ড্রসফিলাতে আলঝাইমা রোগের একটা রিয়ালিটির কাছাকাছি ক্লজেস্ট মডেলিং দাড় করানো। অন্যদিকে টনি আসলে কি করে সেটা কয়েক ঘন্টা গল্পের পরেও জানা জায়নি। তবে আমার যা মনে হলো, সে একসময় আমেরিকান পলিটিক্স – ওবামার সময়কালে – এ কন্সাল্টেন্ট হিসাবে কাজ করতো। তার পুরো ফ্যামিলির সবাই আইভি লিগ গ্রাজুয়েট। গল্পে গল্পে আরো জানলাম, তার মা এবং বাবার বাসায়, যখন তারা ছোট,  বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট এর মিটিং গুলো হতো। তার অর্থ হলো, তার দাদা-দাদির ও আমেরিকান পলিটিক্সে এলিট লেভেল-এ অনেক শক্ত ভাবে পার্টিশিপেশন ছিলো। টনির ক্ষেত্রে যা হইছে তা হলোঃ মিডিল এজে এসে এখন তার আমেরিকা আর ভালো লাগেনা। তাই, প্যারিসে এসে এখন বিজনেস করে এবং মাঝে মাঝে সময় পেলেই ইউরোপ ঘুরতে বের হয়ে পড়ে।  

যাইহোক, গল্পের এক পর্যায়ে আঞ্চি টনিকে আমার বই এর প্রতি ভালোবাসা, স্পেশালি দস্তয়েভস্কি লাভ, নিয়ে বলতেছিলো।  কন্টেঙ্কটা হলো, সপ্তাহ খানেক আগে লাঞ্চ টেবিলে আমরা সবাই বই নিয়ে আলোচনা করতেছিলাম। আলোচনা টা শুরু করেছিলো ম্যাক্সিম। সে বলতেছিলো, ফ্রান্স এ শিশু বয়স থেকে শুরু করে টিনেজ বয়স পর্যন্ত কমিক পড়ার একটা স্ট্রং কালচার আছে। পরে তার আলোচনাই আমরা সবাই যোগ দিলাম। কারেন্টলি কে কি বই পড়তেছে এসব আরকি। গল্পের একটা পর্যায়ে কার কোন রাইটার ফেভারিট সেটা আসলো – যথারিতী। আমি, আঞ্চি আর আমার কো-সুপারভাইজর এক সময় দস্তয়েভস্কি নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। Is ‘The brother Karamazov’ the greatest novel of all time? এর প্রশ্ন নিয়ে অনেক্ষন কথা হলো – একেকজন কেস দাড় করাচ্ছিলো তার দিক থেকে।


এখন ফিরে আসা যাক ক্যাফের আড্ডা তে। আঞ্চি আমাকে মেনশন করে টনিকে বলতেছিলো, ‘Amit also love Dostoyevsky! We should open a Dostoyevsky club here!’ – টনিতো লাফ দিয়ে উঠলো এই কথা শুনে। তারপর, আমার দস্তয়ভস্কির কোন বই ভালো লাগে, কেনো লাগে, তার কেন লাগে এগুলো নিয়ে গল্প শুরু হলো। আমার আবার একটা বৈশিষ্ট হলো, কিছু স্পেসিফিক বিষয়ে (বই, ক্রিকেট, ফুটবল, সাইকোলজি, জীবনের ফিলোসফি) গল্প শুরু হলে, আমি একদম ইনভল্ভ হয়ে যায়। মনযোগ পুরোটা দিয়ে গল্প এবং গল্পের মানুষটাকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করি। গল্পে গল্পে আমি আমার নিজের চাইতে টনিকে বেশি এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করতেছিলাম। কিভাবে তার বই পড়া শুরু, কে কে তার ফেভারিট রাইটার, কি ধরনের বই পড়তে সে ভালোবাসে, আমেরিকান পলিটিক্স এবং ওভারোল কি অবস্থা – এগুলো আরকি।

বই পড়া নিয়ে টনির বিষয়ে যা জানলাম, তা ছিলো অসাধারন। সে বলতেছিলো, তার বাসায় বসার ঘর থেকে শুরু করে কিচেন পর্যন্ত বিভিন্ন লেখকের বই-পত্র ছেটানো থাকত। বয়স দশ হওয়ার আগেই আলবার্ট কামুস, শপেনহাইমার এবং ফ্রয়েড এর সাথে তার পরিচয়। পরের দিকে দস্তয়েভস্কির প্রেমে পড়া, এবং জর্জ ওরয়েল, কিয়ের্কিগার্ড নামক রাইটার দের বই চুশে খাওয়া। এতসব রাইটার দের মাঝে তার কাছেও দস্তয়েভস্কির লেখা ছিলো সবচেয়ে প্রিয়। কথার এক পর্যায়ে সে বলতেছিলো, ‘He literally ruined literature for me. After Dostoyevsky, nothing feels like similar! Nobody touched my heart and brain that deep.’ লিটারিলি, নিজের কথাগুলোই জেনো তার মুখে শুনতেছিলাম।

গল্পের ফাঁকে, আমার প্রফেসর, আমাদের সবার সাকসেস সেলেব্রেট করার কথা মনে করিয়ে দিলো। কিছুক্ষন গ্লাস উচিয়ে চিয়ার্স করে (সবার সাকসেস ধরে ধরে বলতেছিলো), আবার আমরা গল্পের সাগরে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষনে আমার প্রথম গ্লাস কোক খাওয়া শেষ। প্যারিসের বিকেল ঘনিয়ে তখন সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। ইতোমধ্যে, দিনের তাপদাহ শেষ হয়েছে, এবং সন্ধ্যার আগের শীত শীত হাওয়া বওয়া শুরু হয়েছে। গায়ে শুধু একটা টি শার্ট থাকার দরূন ঠান্ডা লাগা হালকা পাতলা শুরু হয়েছে। কিন্তু, গল্পের তালে মন দিতেই তখন বেশি ভালো লাগতেছিলো। 

গল্পে গল্পে আমরা বই থেকে ঢুকে গেলাম পলিটিক্সে। আঞ্চি চাইনিজ হওয়াই স্বভাবতই আমাদের পলিটিকাল ডিস্কাশন মুভ করলো আমেরিকাকে অর্থনিতীকে চাইনার অর্থনিতী ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে। আঞ্চি বলতেছিলো বেইজিং এর মানুষজনের কাজের প্রতি অসাধারন নিউ এডিকশনের কথা। তারা কিভাবে জীবনকে ৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টার ওয়ার্কিং আওয়ারে কনভার্ট করলো (সকাল ৯ টা থেকে রাত ৯ টা) সেটার কথা। পরের দিকে সাবকন্টিনেন্ট এর পলিটিক্স এর বেহাল দশা এবং চাইনার আমেরিকাকে ছাড়ায়ে যেতে কতদিন লাগবে? ইজ ট্রাম্প ওয়াজ দ্যা ওরস্ট প্রেসিডেন্ট অফ আমেরিকান হিস্টোরি? – যথারিতী এগুলা নিয়ে কথা শুরু হলো। এর মাঝে আমি কেচ স্টাডি দাড় করানোর চেষ্টা করলাম, কেনো ট্রাম্প একজন কম্পারেটেভলি হার্ম্লেস প্রেসিডেন্ট ছিলো এবং আমেরিকান ইতিহাসে হার্ম্লেস ক্যাটাগরিতে সে কেনো সবার প্রথমদিকে থাকবে। কিন্তু, টনি আমার সাথে এই পয়েন্টটাতে শক্তভাবে ডিস-এগ্রি করলো। তার বায়সনেস টোয়ার্ডস ওবামা তাকে তার রেশনাল মাইন্ড থেকে দূরে রাখলো, তা আমি ভালভাবেই বোঝতে পারলাম। এতক্ষনে সে ২ টা বেয়ার এর বোতল শেষ করে ফেলছে – তারও ইফেক্ট হতে পারে, হা হা হা!!


ওবামা আর ট্রাম্প এর কাহিনী শেষে, টনি আমাকে জিজ্ঞেস করলো ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের পলিটিক্সের রিসেন্ট হালচাল নিয়ে। আমার উত্তর কি হতে পারে তা আপনি হইতো গেইজ করতে পারতেছেন! হা হা হা!! 😀 মাঝে বাদ গেলোনা ইমরান খান আর পাকিস্তানের সমসাময়িক রাজনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে কথা বলতে।

সব ছাড়িয়ে টনি তার নিজের পলিটিকাল জীবনের কাহিনী বলা শুরু করলো। সে ওবামার দুই সময়েই (৮ বছর) কয়েকটা অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি প্রচারনাই কিভাবে ডিরেক্টলি কিভাবে ইনভল্ভ ছিলো –তার কাহিনী। আরো স্পেসিফিকালি বললে, টনি ওবামার নির্বাচনি প্রচারনার স্পিচ রাইটার এর টিমে কিভাবে কাজ করতো – তার বর্ণনা। তার মা-বাবা অন্যদিকে ওবামার নির্বাচনি প্রচারনার কাজে ডিরেক্টলি ফিল্ড পর্যায়ে ইনভোল্ভ ছিল। এসব কথা যখন টনি বলতেছিলো, তখন আমার মনে হচ্ছিলো আমি কার সাথে বসে আছি? হা হা!! যাইহোক, এর পরে আমাদের গল্প মুভ করলো টনির পারসোনাল পলিটিকাল স্মৃতিচারন থেকে আমেরিকার বর্তমান এবং মেজর কিছু দূরবস্থার চুল ছেড়া বিশ্লেষন এর দিকে। 

টনি এবং আঞ্চির কথায় আমেরিকার মেজর কিছু নেগেটিভ সাইডের মধ্যে ম্যাস স্কুল শুটিং, হাউজিং রেট এবং এক্সেসিভ আমাউন্ট অফ হেলথ ইন্সুরেন্স বিষয়গুলো বারবার আসতেছিলো। আঞ্চি তো মাঝে মাঝেই আমাদের কাছে বলে, সে আর কখনই আমেরিকায় ফিরতে চাইনা, যাস্ট এই একটা কারনে। তার সন্তাঙ্কে স্কুল থেকে মৃত অবস্থায় তার কোলে ফেরত চাইনা। পরেরদিকে, তার কাছে বস্টন এবং ক্যালিফর্নিয়া শহরের বাসা ভাড়ার বর্তমান উর্ধগতিন শুনে আমার চোখ রিতীমত কপালে উঠলো। একটা সিঙ্গেল স্টুডেণ্ট এর শুধু বাসার রেন্ট নাকি ৮০০-১৫০০ ডলার। ভাবা যায় বিষয়টা!! ইভেন প্যারিসের সাথে কম্পেয়ার করলেও বিষয়টা অনেক বেশি। যদিও মানুষজন প্যারিসকে দুনিয়ার ওয়ান অফ দ্যা এক্সপেন্সিভ সিটিগুলোর একটা বলে। এসব খুব কাছ থেকে শুনার পর, নিজের পিএইচডি করতে আমেরিকায় যাওয়ার ডিসিশন ও কয়েকবার ভেবে দেখতে হবে বলে মনে হলো। অন্তত কোন শহরে যেতে চাচ্ছি এবং সেটার অবস্থা কেমন (বাড়ি ভাড়া, ফ্রেকুয়েন্সি অফ ম্যাস শুটিং ইত্যাদি) এগুলো নিয়ে আরো ডিটেইলস জানশুনা দরকার আছে বলে মনে হলো।

তবে গল্পে গল্পে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর আমেরিকান ইস্যু বলে যেটা মনে হলো সেটা হলো হেলথ ইন্সুরেন্স। হাজার হাজার ডলার এর ইন্সুরেন্স থাকার পরও ডাক্তারের কাছে সঠিক সময়ে আপয়েন্টমেন্ট না পাওয়া, এক্সট্রা পেইমেন্ট দিয়ে ডক্টের দেখানোর অহরহ কাহিনী আমার চোখ খুলে দিচ্ছিলো। হেলথ ইন্সুরেন্স থাকার পরও আঞ্চির ব্যাচেলর লাইফে একবার যাস্ট কানের ময়লা পরিষ্কার করে ৪০০ ডলার খোয়াতে হয়েছিলো তার কথা শুনে রাগও লাগতেছিলো, আবার হাসিও পাচ্ছিলো। পরে আমি জিজ্ঞাস করলাম, বিষয়টা কিভাবে দাড়াল এরকম করূন একটা পর্যায়ে? উত্তরে টনি এবং আঞ্চি যেটা বলার চেষ্টা করলো সেটা হলো, আমেরিকান ইডুকেশন এর এক্সেসিভ কস্ট। একটা মেডিকাল স্টুডেন্ট এর যাস্ট পড়াশুনা শেষ করতেই লক্ষ লক্ষ ডলার যে চলে যায়, তার প্রভাব তার ডাক্তার হবার অর সাধারন মানুষের উপর পড়ে। সে কারনে ডক্টর হবার পর তাদের মেইন টার্গেটই থাকে বেশি পরিমান টাক নেওয়া পেশেন্টদের কাছে থেকে। এখানে সরকার এর কোন সুনির্দিষ্ট বাধা ধরা না থাকায়, বিষয়টা আস্তে আস্তে এখন এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে গেছে। এসব কথা শুনে একটা ক্যান্সার পেশেন্টের কি পরিমান টাকা পয়সা যায়তে পারে, তা আমি মনে মনে ভাবতেছিলাম আর ভয় পাচ্ছিলাম।

আমেরিকান হেলথ ইন্সুরেন্স এর গল্প করতে করতে প্যারিসের বেলা ডুবে এলো। এতক্ষনে ঠান্ডা লাগাটা বেড়ে শরীর এর মধ্যে কাপুনি দেওয়া শুরু করেছে। আমরা দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়ে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আসার সময় টনি আমাকে পরের বার গলফ খেলতে এবং তার বাসায় গল্প করতে দাওয়াত করলো। সব ফরমালিটি শেষ করে ঘুম ঘুম চোখে আমি বাস ধরলাম রুমে আসার জন্য।

Post Views: 507
Share this content