ঢাকা ছেড়ে আসা বাস রাজশাহী নামিয়ে দিল ভোর চারটায়। এত দ্রুত নামিয়ে দেবে ভাবিইনি।
লাস্ট প্রপারলি রাতে ঘুমিয়েছিলাম আগস্টের ৩১ তারিখ। জীবন এক আশ্চর্য ভ্রমণ – সেটাই উপভোগ করছি নানাভাবে।
যাই হোক, মাথায় চুলের জটলা পাকিয়ে, চোখ লাল আর শরীরে লেগে থাকা প্রাচীন মানুষের গন্ধ নিয়ে রেলগেটে নামলাম।
দেখলাম, অনেকের কাছে এই ভোর চারটা অনেকখানি সকাল হয়ে গেছে।
চায়ের দোকানগুলো ধুমছে সচল। চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কয়েক ডজন মানুষ।
কিছু ৫০ ঊর্ধ্ব মানুষ কাশি দিতে দিতে বিশাল সাইজের দুটি সিলভারের হাঁড়ি নিয়ে বের হয়েছে – সকালের জন্য মাছ কিনতে হবে, আবার বাজারে ফিরে আসতে হবে।
কয়েকজন সিএনজি চালক সিগারেটে টান দিতে দিতে বাস থেকে নামা লোকজনকে ডাকছে, “যাবেন নাকি সাবায়, কেশর, নওগাঁ, ভবানীগঞ্জ…।”
সিএনজির দুটো সিট বুক করে বসলাম পেছনে। আমার পাশের দুই মাঝবয়সী মানুষ (চুল-দাড়ি সাদা) ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাঝে মাঝে দুলতে দুলতে আমার লাগেজের ওপর হাত ছড়িয়ে দিচ্ছে – হালকা সজাগ হচ্ছে – আবার ঘুমে মাতাল হয়ে যাচ্ছে।
সিএনজির ড্রাইভার ছাড়া আমার বিশ্বাস সবাই প্রায় ঘুমে মাতাল।
নওহাঁটা পর্যন্ত রাজশাহী-নওগাঁ রোডের অপরূপ আলোগুলো দেখতে দেখতে এখন রাস্তায় খানিকটা অন্ধকার নেমে আসছে। ইনফ্রিকুয়েন্ট রাস্তার বাতি আর অল্প চাঁদের আলো পরিবেশটাকে আরও মাতাল করে তুলেছে।
সিগারেটের আলো এখানে বেশ শক্তিশালী – কিছু কিছু মোড়ে কিছু কিছু মানুষের কাছে যা একমাত্র ভরসা কিংবা স্ট্রেস রিলিফের একমাত্র মাধ্যম।
দেখতে দেখতে কেশরহাঁটে পৌঁছে গেলাম। এক চায়ের দোকান ঘিরে দেখি এই রাতে মৌমাছির মতো মানুষ। ঘিরে ধরে সস্তা নেশাটা সেরে নিচ্ছে।
‘মৌচাকের’ পাশ দিয়ে পান-বরে থেকে গতকালের ছেড়া পান-বিড়ি মাথায় নিয়ে হাঁটে যাচ্ছেন কিছু পুরুষ, মাঝবয়সী টিনএজার আর কিছু বাবা।
কিছুদূর এগোতেই ফজরের প্রথম আজান পড়ে গেল। মাঝবয়সী লোক দুটি হাঁড়ি নিয়ে কাশতে কাশতে, কী জানি বলতে বলতে ভাড়াটা দিয়ে নেমে গেল।
আমি এখন সিএনজির পেছনে একা। হালকা চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে বাইরে। সামনে হয়তো একটা শ্মশান ঘাট পড়বে, তারপর আরও কিছু অন্ধকার-আলো খেলা। তারপর ধানক্ষেত, গমক্ষেত, তারপর ১০-১৫ কি:মি:, এবং আমার বাড়ি।
বহু বছর আগে যে বাড়িটা ছেড়েছিলাম আগস্টের ভরদুপুরে কিছু একটা করতে হবে বলে। মাঝে চলে গেছে এক যুগেরও বেশি।
গ্রামের অনেক প্রবীণ এখন আর বেঁচে নেই। কত পিচকি পাচকা বড় হয়ে গেছে, আমাকে তারা হয়তো আঙ্কেল ভাবে।
খেলার মাঠগুলো আর নেই। নেই আমার বন্ধুরা।
আমার একটা ফিলোসফি আছে: প্রতি এক যুগে গ্রাম তার স্মৃতি ইরেজ করে ফেলে।
আমার মনে হয়, আমাদের জেনারেশনের স্মৃতিটা আমাদের গ্রাম মুছে ফেলছে। সেই জায়গাগুলো আর ঠিক সেইভাবে নেই, বিকেলগুলো আর হয়তো সেই দূরন্ত বিকেল নেই, উদ্দীপনা তো কবেই ‘কাজ আছে’ বলার ছলে বিলীন হয়ে গেছে।
তারপরেও বারবার ফিরে আসি এ গ্রামে। কারণ এটা আমাকে সবচেয়ে বিশুদ্ধতম ভাবে নস্টালজিক বানায়।
আর সেটা কে না হতে চায়।
নস্টালজিক হওয়া যে মানুষের আদিমতম নেশার একটি।